স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারির নিশ্চয়তা চাই ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতে চাই কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা

0
96

আসছে মুসলমানদের পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। এই এক উপলক্ষ নিয়ে প্রতিবছর রাজধানীসহ সারা দেশে প্রচুর ইফতার জাতীয় খাবার বিক্রি হয়। এই সুযোগেই মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় ইফতারিতে অনায়াসে ভেজাল মেশায়। খাদ্যে ভেজাল এমন একটি নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে সুস্থ মানুষকে সুস্থ ধারা থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমাদরে দেশের অধিকাংশ মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।

এমতাবস্থায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ সমমনা ১০ টি সংগঠন- পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ, নগরবাসী সংগঠন, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ), মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্র, আলোকিত বন্ধু সংঘ, বিডি ক্লিক, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদ, সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণ সংগঠন এর যৌথ উদ্যোগে আজ ২ এপ্রিল ২০২২, শনিবার, সকাল ১০ টায় চকবাজার জামে মসজিদের সামনে, ঢাকা “স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারির নিশ্চয়তা চাই;ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতে চাই কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা” শীর্ষক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান-এর সভাপতিত্বে সঞ্চালনা করেন পবা’র সহ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ উক্ত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. আবদুস সোবহান, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগ এর সভাপতি নাজিমউদ্দীন, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চ’র সভাপতি আমির হাসান মাসুদ, সুবন্ধন’র সভাপতি মো: হাবিবুর রহমান হাবিব, নগরবাসী সংগঠন’র সভাপতি হাজী আনসার আলী, নাসফ কেন্দ্রীয় কমিটি’র তথ্য গবেষণা সহ সম্পাদক মোস্তাফা ইকবাল চৌধুরী, কবি পরিষদ সদস্য মো: ইব্রাহীম হোসেন, সুজন’র সহ সভাপতি ক্যামেলিয়া চৌধুরী, আলোকিত বন্ধু সংঘ’র সাধারণ সম্পাদক হাজী মো: রনি, বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম টুব্বুস, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রে’র সদস্য শাহিন ইসলাম, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নাসফ’র সি এম শাকিল রহমান, প্রমুখ।

রমজান মাসে ইফতারিতে যেসব খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বেশী চাহিদা সেগুলো হলো শরবত, খেজুর, ছোলা, মুড়ি, বেসন, ডাল, তেল, চিনি, দুধ, সেমাই, মুরগী, মাছ, দেশী-বিদেশী ফল, শসা, টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, আটা, ময়দা, ইত্যাদি। রমজানের বাজার ধরার লক্ষ্যে এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও মজুত করতে বিষাক্ত কেমিক্যাল, কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন, ফরমালিন ও মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইফতারিতে যেসমস্ত খাদ্যপণ্য বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর উৎপাদন, আমদানি, মজুতকরণ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। অসাধু শিল্পপতি, উৎপাদনকারী, কৃষক, ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, মজুতদার, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা অধিক মুনাফার লোভে এসব খাদপণ্যে ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভেজালের মিশ্রণ করে থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটরযান, নৌযান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করার ফলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরী করা হয়। সেমাইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই উৎপাদন এবং তাতে রাসাযনিক দ্রব্য মিশানো হচ্ছে। যা আমাদেরকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইফতারিসহ সকল খাদ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত করতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বিষ ও ভোজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে।

এমন কোন খাদ্যদ্রব্য নেই যাতে মারাত্মক ক্ষতিকর বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশানো হয় না। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। সহজপ্রাপ্যতা আইন প্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে, যাতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুভাব বেড়ে যাচ্ছে। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ- মাংস, দুধ, মিষ্টি, প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয়সহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশানো হয়। ফল ও তরিতরকারি দ্রæত বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন, কীট পতঙ্গ প্রতিরোধে নিষিদ্ধ বিষাক্ত কীটনাশক এবং তাজা ও সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল কৃত্রিম উপায়ে পাঁকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন প্রয়োগ করা হয়। মাছে ফরমালিন, মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বোতল ও প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন শরবত, ফলের রস, জ্যাম-জেলীতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে কৃত্রিম মিষ্টিদায়ক, আলকাতরা এবং কাপড়ের রং প্রয়াগ করা হয়। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে এসবের প্রভাবে গলায় ক্যান্সার, রক্ত ক্যান্সার, হাঁপানি এবং চর্ম রোগ হয়। ফরমালিনযুক্ত খাবারে পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, অস্থিমজ্জা জমে যায়।

ইফতারসহ খাদ্যে হাইড্রোজ, রেড-অক্সাইড, মনো সোডিয়াম, গøুটামেট, ট্রান্সফ্যাট, ব্যবহৃত তেল, টেক্সটাইল কেমিক্যাল, বিপদজনক সুগন্ধি ও রাসায়নিক মেশানো বা ব্যবহার করা যাবে না। নিরাপদ খাদ্য জমি, খামার ও বাগান নিরাপদ হতে হবে। সেজন্য কৃষক ও উৎপানকারীকে নিরাপদ বিষমুক্ত শস্যফসল উৎপাদনরে জন্য সহযোগিতা করতে হবে। পরবতীতে খাদ্য পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুদতকরণ, পরিবেশন সকল ক্ষেত্রে ইফতারসহ খাদ্য নিরাপদ হতে হবে। এছাড়া ইফতারে তেল জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রচুর পানীয় বা রসালো খাবারের পাশাপাশি নানা রকম আঁশ জাতীয় ফলমূল খাওয়া উচিত। এসব আঁশযুক্ত ফলমূল, দুধ জাতীয় খাবার ও সবজি শরীরে বেশি সময় পানি ধারণ করে রাখে যা শরীরকে ‘ডিটক্সিফাইন’ হতে সাহায্য করে ফলে শরীর সুস্থ থাকে।

বাংলাদেশে শুধু নয় বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্যে ভেজাল ও আইন অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ একটি বিষয়। মানুষরে সবচেয়ে  প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে খাদ্যকে নিরাপদ রাখার লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্য ভেজাল ও বিষক্রিয়া রোধ করা। বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় বর্তমান সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও রয়েছে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সুনিদিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার যথাযথ উদ্যোগ ও অঙ্গীকারের অভাব, বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনুধাবনে ব্যর্থতার ফলে আমরা জনগণ এর কোন সুফল পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হব।

খাদ্য মন্ত্রণালয়কে ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও নিয়ম পালনে আন্তরিক হতে হবে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত সব প্রক্রিয়া পরিদর্শনের আওতায় আনতে হবে। সরকারের একার পক্ষে ভেজাল প্রতিরোধ সম্ভব নয়, এর সঙ্গে প্রশাসন ও জনগণের সম্পৃক্ততা জরুরি। বিভিন্ন সময় বিশেষ করে রমজান মাসে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। তবে তা খুবই অপ্রতুল। ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান আরো জোরদার করতে হবে এবং নিষিদ্ধ হওয়া পণ্যগুলো যেন বাজারে আবার ফিরে না আসে সে বিষয়ে কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি। ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে যথাযর্থ কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত খাদ্য পরীক্ষা ও তদারকি করতে হবে। খাদ্য পরীক্ষার ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে যাতে করে সচেতনতা বাড়ে। যারা স্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য উৎপাদন করে তাদের উৎসাহ প্রদান করা এবং বিষ ও কেমিক্যাল প্রয়োগকারী খাদ্য সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।

সুপারিশসমূহ:
১. ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে  উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানোর আগে সকল খাদ্যদ্রব্য নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং তার ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করা যেন সচেতনতা বাড়ে। যারা স্বাস্থ্যকর খাদ্য সরবরাহ করবে তাদের পুরস্কৃত করা এবং ভেজাল ও বিষাক্ত খাবার সরবরাহকারীদের আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
২. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এবং ফরমালনি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৩. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত ও ভেজাল খাদ্য বিক্রয়কারীদরে  বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে ও  মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদান অব্যাহত রাখা।
৪. ভেজালকারী যেই হোকনা কেন জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আইন প্রয়োগে সরকাররে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষপে গ্রহণ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা যাবেনা।
৫. সরকারের নীতি নির্ধারণী ফোরামে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক আমদানির উপর পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা সুরুপ পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক বন্দরসমূহে বিভিন্ন রাসায়নিক  দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা। একই সাথে আমদানিকৃত রাসায়নিকের ব্যবহার যাতে সীমিত থাকে সেজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে।
৬. গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে কৃষক, উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের রাসায়নিক দ্রব্যাদি কীটনাশক, ভেজাল মিশ্রণের ক্ষতিকর দিক এবং আইনে বর্ণিত দন্ড তুলে ধরে সচেতন করা।
৭. বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা।
৮. দেশের বিদ্যমান আইনগুলোকে যুগোপযোগী ও আরো কঠিন শাস্তির বিধান করা খাদ্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে এমন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যেন ভবিষ্যতে এসব অপরাধ করতে না পারে।
৯. সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে